
ফেব্রুয়ারী মাস নিয়ে লেখা মানেই কিভাবে ২১ এলো, কি এর মহিমা, এর অতীত, এর প্রভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে বাংলা ভাষার জন্য ফেব্রুয়ারী মহিমাময় হল, তার করুণ হাল কি আমাদের জানা আছে??
একজন বাংলাদেশীর অহংকারের জায়গাগুলো কি কি? আমাকে এই প্রশ্ন করা হলে অনেক গুলো উত্তর পাবেন। এই যেমন ধরুন প্রথমেই বলব মুক্ত ভাবে সমালোচনার অধিকার, তারপর সাকিবের ফর্ম, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি। কিন্তু এর সাথে একটি বিষয় যোগ না করলেই নয়, আর তা হল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। বিদ্বানরা বলেন “মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয় ভাষা আন্দোলন।” কিন্তু আমি বলব বায়ান্নর ভাষা সংগ্রাম আরো বেশি সফল। ভাষা আন্দোলন শুধু একটি যুদ্ধের রাস্তা করে দেয়নি, দিয়েছে আর অনেক বড় কিছু। সেটি হল মনকে মুক্ত করা। ভাষা ব্যতিত মন বিকশিত হয়না আর মন বিনা মানব সত্তা সম্ভব নয়। বায়ান্নর বীর ছাত্ররা এই সত্যটি বুঝত বলেই গুলির সামনে দাড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি। অথচ তাদের এই আত্মত্যাগ কিন্তু মাঠেই মারা গেল। যে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার আশায় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ রক্ত ছোটালেন, তার কানাও পূর্ণ হয় নি। হয়ত আমাকে নিরাশাবাদী বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু এটাই সত্যি। ফেব্রুয়ারী মাস এলেই আমাদের অন্তর আচানক ই বাংলা প্রেমিতে পরিনত হয়। যেদিকে তাকাই, মাথায় বর্ণমালা সজ্জিত টুপি, বর্ণমালা ছাপা কাপড়চোপড়, মোবাইলে “আমার ভাই এর রক্তে……” গানের সুরের রিংটোন এর ফল্গুধারা ছোটে। উঠতি বয়সের অর্বাচিনরা সর্বত্র নতুন বাংলা ফ্যাশন এর মুফতি প্রচারনা চালায়, যদিও এদের কেউই বাংলা বর্ণমালা আদি হতে অন্ত পুরোটা জানেনা। আবার হাল ফ্যাশনের বাবা-মা রা চান তাদের ছেলে মেয়ে ইংরেজি বিদ্যালযে পড়বে, ফিরিঙ্গি আদলে বুলি আউড়াবে। তাদের এ ধরনের আকাঙ্খার কারণ?? তাদের যুক্তি- বাংলা একটি সীমিত ভাষা, সন্তানেরা পড়তে বিদেশ যাবে, তাদের “Smart” হয়ে বড় হতে হবে না??এর জন্য ইংরেজি এর তুলনা নাই!!
অথচ, এই বাংলার জন্য সম্ভাবনা কত তরুণের প্রান ঝরে গেল বায়ান্ন তে। নিদেনপক্ষে আজকের এই “HYBRID” বাঙ্গালী জাতের থেকে তো তারাই দেশের জন্য অনেক করতে পারতেন! আমরা এতোটাই খবিশ,ফেব্রুয়ারী ১-২৮, কখনও ২৯, এটাই আমাদের বাংলা বেশের মেয়াদকাল।ফেব্রুয়ারী শেষ, আমাদের বাঙ্গালীপনাও বিদায় নেয়, আবার আগামী বছরের ফেব্রুয়ারীর আশায় দিন গোনে। সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন দেখি তারুণ্য ফেব্রুয়ারী মাস মানেই বইমেলার মাস ধরে বসে! যে কারণে ফেব্রুয়ারী এত মহান, তার কোন খোজ ই নাই!! আর লজ্জার বিষয় যখন দেখি বিদেশী ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের থেকে বেশি ইতিহাস জানে! এইত জানুয়ারীর মাঝামাঝি গিয়েছিলাম শহীদ মিনারে, গিয়ে দেখা জনাকতক বিদেশীর সাথে। তারা শহীদ মিনারে এসেছে কারন যে ঘটনার জন্য “International Mother Language Day” এর জন্ম, তারা সেই জায়গাটা দেখতে আজ ঢাকায়, সেই সুবাদে এখানেও আসা। কথা বলে জানলাম তাদের জানার পরিধিটা অনেক বিশাল! এতোটা আমাদের সকলেরই হয়তো জানা নেই।তাদের একটা কথায় খুবই লজ্জা পেলাম, তা হল শাহীদ মিনার টা এত নোংরা কেন?? তাদের তো আর জানা নেই আমাদের “বাঙ্গালীপনা”র শুরু হতে আর অল্প কদিন বাকি, তারা একটু আগেই এসে গেছেন। ফেব্রুয়ারী তে এলেই অন্য চিত্র!
এতো হতাশার মধ্যেও কিছুটা আশা আছে, সেটা না বললে দোষ হয়ে যাবে। বইমেলার সাথেই দেখি সেদিন কিছু যুবক মাইক হাতে নিয়ে সবাই কে ডাকছে, কিছুতে সই করার জন্য। কি সেটা? সেটা হল জাতিসংঘে বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক মানে “Official” ভাষা করার আবেদন, যার জন্য ৫ কোটি বাঙ্গালীর সই দরকার। হয়ত , না হয়ত না, বাস্তবে তাদের এই চেষ্টা হয়ত কোনদিন সফল হবে না, জাতিসংঘের অতীত সেটাই বলে। কিন্তু তাও এই তরুণরা বাংলা ভাষাকে নিয়ে কিছু করার চেষ্টা তো করছে! আমাদের মতো গায়ে বর্ণমালা সেটে তো আর বসে নেই।
বাংলা ভাষাকে শুধু একটি মাসের জন্য আপন করলে চলবে কি ভাবে?? যে ভাষার জন্য আজ আমদের জাতি হিসেবে একটি পরিচয় আছে, সেই ভাষাকেই যদি ঠিক মতো না মানি, তাহলে আমাদের শিকড় কেই অস্বীকার করা হবে। একটি লেখায় পড়লাম, লেখক আশঙ্কা করছেন, আগামি দশকের মধ্যে বাংলাদেশীরা বাংলা পড়তে ও লিখতে ভুলে যাবে, কারণ আমাদের বাংলা বিমুখীতা, আর অন্য ভাষা প্রিয়তা…। যেই বাংলা ভাষার প্রেমে আমাদের অগ্রজরা সর্বাত্মিক ত্যাগের নিদর্শনের ধারক, তাদেরি অনুজ হয়ে আমরা এই ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান, এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য চরম অবমাননাকর!! আশা করি, বাংলা আমাদের মধ্যদিয়ে বেচে থাকুক অনন্তকাল, কারণ আমরা এর মাণ রাখতে না পারলেও, হয়ত আমাদের ই কোনও এক প্রজন্ম এর কদর বুঝবে।